লতাবুনি-আদিবাসী গ্রামে মাটির বাড়ি নিয়ে এক বিচিত্র শিল্পপ্রকল্প; কয়েকজন তরুণ শিল্পীর এক অনন্য শিল্পকর্মের বুনোন। লিখছেন– শিল্পী সৌরভ নন্দী।
লতাবুনি -শিল্প কর্মশালা
আমরা কয়েক জন শিল্পী বন্ধু মিলে ঠিক করি নিজেদের উদ্যোগে কোন প্রান্তিক গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের সাথে মিলে একটি সহযোগী শিল্প প্রকল্প (collaborative art project )ও শিল্প কর্মশালার আয়োজন করবো। সেই মতো পৌঁছে যাই বীরভূমের সদর শহর সিউড়ী থেকে ১৪ কিমি: দূরে প্রান্তিক আদিবাসী গ্রাম ‘জামদহ’, লতাবুনি গ্রামে। এবং এই শিল্প প্রকল্পের নাম রাখি ‘লতাবুনি ‘। যদিও আমরা যে গ্রামটিতে শিল্প কর্মটি করি তার নাম ‘জামদহ’ ।এটি একটি আদিবাসী গ্রাম বললে ভুল হবে , আসলে একটি পাড়া। যেমন সুন্দর এই গ্রামগুলি তেমনি সুন্দর এই আদিবাসী গ্রামগুলির নাম ও মানুষ জন । এর ঠিক পাশের গ্রামটি হলো লতাবুনি। এই বুনি কথাটির সাথে বুনোন শব্দটি জড়িত। তাই আমরা ঠিক করি এই পরিবেশে আমাদের শিল্পের বুনোন গড়ে তুলবো ।
মাটির বাড়ি ও লতাবুনি
জঙ্গলে ঘেরা বীরভূমের এই আদিবাসী গ্রামগুলি । সবুজের মাঝে এলোমেলো ভাবে সাজানো ১০/১২ টি মাটির কুঁড়ে ঘর নিয়ে এক একটি আদিবাসী গ্রাম গড়ে উঠেছে । দূরে তাকালে খয়েরি ধূসর রুক্ষ জমির মাঝে মাঝে কাঁচা হলুদ রঙের সর্ষের ক্ষেত। যেন মনে হচ্ছে কেউ হলুদ রঙ দিয়ে একটি করে তুলির আঁচড় কেটে দিতে দিতে চলে গিয়েছে । আর মাঠের মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্ত ভাবে তালআর খেজুর গাছ খাড়া হয়ে একাকী দাঁড়িয়ে আছে ।বাঁশ বন থেকে ভেসে আসছে শুকনো পাতার মরমর শব্দ। দূরে বেশ উঁচু একটি পাথরের টিলা দেখা যাচ্ছে । এখান ওখানে ছড়িয়ে রয়েছে ছোট ছোট পাথুরে ঢিপি । ছবির মতো গ্রাম লতাবুনি।
ছবির মতো গ্রাম লতাবুনি
পাকা রাস্তা থেকে নেমে গিয়ে রাঙা মাটির রাস্তা। গ্রামের মধ্যে দিয়ে যেন লাল রেখা টেনে দূরে মিলিয়ে গিয়েছে । গ্রামে ঢুকতেই দেখলাম একটি ছোট্ট জল শূন্য ডোবা। কয়েকটি আদিবাসী বাচ্চা ছেলে খেলার ছলে কাদা মাখামাখি করে পাঁকের ভিতর থেকে মাছ ধরছে। মাছকে তাদের ভাষায় ‘হাকু’ বলে । গ্রামের এদিক ওদিকে দাঁড় করানো রয়েছে গরুর গাড়ি। আর ছোট্ট খড়ের চালাতে বাঁধা রয়েছে গরু ।এই কয়েক দিন আগে ‘বাদনা পরব’ গিয়েছে। তাই প্রতিটি বাড়ী ও উঠান সব সুন্দর ভাবে নিকানো। কোনো কোনো বাড়ীর দেওয়ালে জ্যামিতিক নক্সা করা। মাটির রিলিফে ফুল, লতাপাতা, ময়ূর ইত্যাদির কাজ করা ।
লতাবুনি গ্রামের প্রতিটি বাড়ীর উঠানে ধানের মড়াই ও খড়ের পালুই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ।
শিল্প প্রকল্প ও শিল্পী
- এই গ্রামগুলির মূল জীবিকা চাষবাস।
- বীরভূমের এইদিকের রুক্ষ জমিতে বছরে একবারই ভালো চাষ হয়।
- আর সেই থেকে যা আয় হয় তাই দিয়েই এই গ্রামগুলির মানুষের সারা বছর চলে ।
- এই টুকু পেয়েই তারা তৃপ্ত।
- এতো চাওয়া পাওয়ার হিসাব তারা করে না ।
- পুঁথিগত শিক্ষার আলো এই প্রান্তিক গ্রামগুলিতে সেই ভাবে আলো বিস্তার করতে পারেনি বললেই চলে ।
- আমরা ঠিক করি লতাবুনি গ্রামের মানুষগুলির সাথে একাত্ম হয়ে আমাদের শিল্প কর্ম গড়ে তুলবো।
- আর সেই উদ্যোগের প্রস্তুতিও আরম্ভ করে দি ।
- আমাদের এই কাজে সহযোগী শিল্পী বন্ধুরা হলেন সৌরভ নন্দী ( বীরভূম ),
- দেবজিত্ রূদ্র পাল (ত্রিপুরা ), চয়ন দাস ঠাকুর ( বীরভূম)
- সিদ্ধার্থ শীল (ত্রিপুরা ),সুশান্ত মিস্ত্রী (দক্ষিণ ২৪পরগনা ),
- চন্দ্রা বণিক (ত্রিপুরা ) ও অদ্বিতীয়া সরকার (শিলিগুড়ি )।
- আমরা সকলেই সদ্য বিভিন্ন আর্ট কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেছি ।
আমার সিউড়ী বাড়ী হবার কারণে গ্রামের দুই একজনই আমার সাথে ছিল পূর্ব পরিচিত । বাকি সমস্ত গ্রামবাসী অচেনা। প্রথমে গ্রামবাসীরা আমাদের দেখে একটু অবাক হয়। কি জন্য এসেছি, কেন এসেছি এই রকম বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় । তাদের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে কিছুটা বোঝাতে সমর্থ হই । আমাদের এই শিল্প কর্মশালার দিন ঠিক করেছিলাম ২১-৩১ শে জানুয়ারি ২০২০ । প্রথম দুই দিন আমরা ৭ জনই গ্রামবাসীদের সাথে একটু পরিচয় করবার চেষ্টা করি । এর পর ‘সীমন্ত সরেন’ নামে ঐ গ্রামের একজন আদিবাসী ব্যক্তি তার বাড়ীর উঠানটি কাজ করার জন্য আমাদের দেয় । লতাবুনি-তে তার উঠানেই শুরু হয় শিল্প নির্মাণের কাজ ।
লতাবুনির মাটির বাড়ি
সেখানে একটি মাটির ভাঙা দেওয়াল চোখে পড়ে । সীমন্তের স্ত্রী আমাদের শিখিয়ে দেয় কিভাবে তারা তাদের বাড়ীর দেওয়াল মাটি দিয়ে সুন্দর ভাবে নিকায় । প্রথমে বীরভূমের লাল মাটি দিয়ে দেওয়ালটি নিকানো হয় । তারপর হাতে একটি সমতল পাথর নিয়ে সেটিকে ঘষে দেওয়াল লেপা মাটিকে সমতল করা হয় । ঠিক যেমন ‘করনিক’ দিয়ে রাজমিস্ত্রি দেওয়াল প্লাস্টার করে তেমন । এরপর শুকালে গোবর দিয়ে কাপড়ের সাহায্যে নেকানো বা উলুটি দেওয়া হয় । আমরাও ঠিক সেই ভাবে লতাবুনি গ্রামের ঐ ভাঙা দেওয়ালটিকে নিকিয়ে আঁকবার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করলাম ।
রঙ ও মোটিফ
তার উপর ছবি আঁকার জন্য লাল রঙ হিসাবে ব্যবহার করা হলো বীরভূমের লাল মাটি । কালো রঙের জন্য উনুনের পোড়া কালো ছাই দেখলাম। তার সাথে গোবর মিসালে সেটি ‘binder’ এর কাজ করে। সহজে উঠে যায় না।সাদা রঙের জন্য ব্যবহার করা হলো খড়ি মাটি । আর দেওয়াল চিত্রের বিষয় হিসাবে উঠে এলো বাদনার সময় তারা তাদের দেওয়ালে যে সব চিত্র আঁকে সেই সব চিত্র ও তাদেরই পরিচিত বিভিন্ন মোটিফ । এরপর দেখতে পেলাম লতাবুনি গ্রামের বাচ্চারাও তাদের উত্সুক মন নিয়ে ভয় জড়তা কাটিয়ে আমাদের সাথে পরিচিত হতে লাগলো ।
লতাবুনি ও ক্ষুদে শিল্পীরা
আমরাও তাদেরকে পেয়ে আনন্দিত ।তারাও আমাদের সাথে তাল মিলিয়ে তাদের কচি হাতে মাটি দিয়ে সুন্দর ছোট্ট ছোট্ট পুতুল তৈরী করতে ও দেওয়ালে তাদের নিজেদের মনের মতো করে ছবি আঁকতে লাগলো । ড্রয়িং করার জন্য ব্যবহৃত হলো কাঠ কয়লার টুকরো । ঐ কচি কাঁচাদের কল্পনা শক্তি সত্যিই অবাক করার মতো ; পাখি, পশু, ষাঁড়, গরুর গাড়ি, ধামসা, মাদল,মোটর বাইক কিছুই বাদ নেই। এমন কি দেখলাম লতাবুনি-তে তাদের দেবতা ‘মারানগুরু’র থান ও তাদের তৈরী মাটির পুতুলে উঠে এসেছে ।তাদের তৈরী এই সব মাটির পুতুল ও বিষয় সত্যিই মুগ্ধ করার মতন । ঐ আদিবাসী বাচ্চাদের অনুভূতি শক্তি ও বিষয়কে দেখবার দৃষ্টিভঙ্গী সত্যিই অবাক করে দেয় ।
আমরাও লতাবুনি গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন সামগ্রী সংগ্রহ করি যেমন কাঠের গুঁড়ি, শুকনো গাছের ডালপালা,তালের রস সংগ্রহের পোড়া মাটির হাঁড়ি, চাষের নাঙ্গল, বসবার জন্য ব্যবহৃত দড়ির খাটিয়া,ঝুড়ি, শালপাতা প্রভৃতি । তাদের পরিচিত সামগ্রী গুলোকে কাজে লাগিয়ে আমাদের শিল্পের ভাষা তৈরী করবার চেষ্টা করলাম । গ্রামের বিভিন্ন প্রান্তে আমাদের তৈরী instillation, side specific instillation, wall mural, wall painting ও গ্রামের বাচ্চাদের তৈরী মাটির পুতুল,দেয়াল চিত্র প্রভৃতি শিল্প মাধ্যমে তাদের গ্রামটি উত্সবের মেজাজে সেজে উঠতে লাগলো ।
লতাবুনি গ্রামের সহযোগিতা
গ্রামবাসীরাও চাক্ষুস করলো তাদের পড়ে থাকা পরিচিত সামগ্রী দিয়ে কীভাবে আমরা শিল্প গড়ে তুলতে কাজে লাগাছি । আমরাও তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখলাম। দেওয়ালের গায়ে তাদের তৈরী মাটির বিভিন্ন রিলিফ, দেওয়াল চিত্র,জ্যামেতিক নক্সা, নিকানো উঠান থেকে শুরু করে তাদের জীবন যাত্রা, উত্সব তাদের হৃদয়ের সরলতা অনেক কিছুই তাদের কাছ থেকে শিখবার মতো । এরফলে তাদের শিল্পের সাথে আমাদের শিল্পের একটা মেল বন্ধন ও পরিচিতি গড়ে উঠলো । আমাদের তৈরী কাজে আদিবাসী সাঁওতালি ভাষার ‘অলচিকি’ হরফও উঠে এসছে । লতাবুনি গ্রামে পড়ে থাকা ব্যবহৃত সামগ্রীই আমাদের শিল্পের বুনোন গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছে । গ্রামের লোকেরা সকালে কাজে যেত । বিকালে কাজ সেরে বাড়ী ফিরবার আগে তারা দল বেঁধে দেখতে আসতো আমাদের শিল্পকর্ম । তারা ছিলো আমাদের তৈরী শিল্প কর্মের দর্শক।
শিল্পের সমজদার
সেই সহজ সরল মানুষগুলি নিজেদের মতো করে আমাদের শিল্প কর্ম বুঝতো ও বিচার করতো। এটিও আমাদের এক বিশাল প্রাপ্তি । এই গ্রামে আদিবাসী নাচের তালে , গানের সুরে ,ধামসা-মাদলের বোলে, লাল মাটির মেঠো রাস্তায়, গোবর নিকানো উঠানে, হাঁড়িয়ার মাদকতায় তৈরী হয়েছে আমাদের শিল্পের ভাষা , যা এক অন্য অনুভূতি এক অন্য পাঠ ।
বিদায় লতাবুনি
আসতে আসতে একাত্ম হয়ে উঠেছিলাম তাদের সাথে। তারাও অতি সহজে আপন করে নিয়েছিল আমাদের
প্রথমত – এ এক অন্য মননের তৃপ্তি।অন্য উপলব্ধি যা ভাষায় ব্যক্ত করা যায়না ।যা শুধু অনুভূতি, একটা বড় পাওয়া ।
দ্বিতীয়ত- ১০ দিন কিভাবে তাদের সাথে কেটে গেলো বোঝায় গেলো না । অনেক শিখলাম তাদের কাছ থেকে যা চিরকাল স্মৃতি হয়ে থাকবে । শেষ দিন আমাদের সবার মন ভারাক্রন্ত।
বিদায় লতাবুনি। দেখলাম তাদেরও মন খারাপ। বার বার বলতে লাগলো– ‘
কাল থেকে তো তুরা আর আসবিনা, সামনে মাঘ পুজোয় আসিস। মাংসোর পিঠা খাওয়াবো ‘ ।